উন্মুক্ত ও মাদরাসার সনদ নিয়ে বিপাকে ইসি
নির্বাচন কমিশনে (ইসি) প্রায় ১০ বছর বয়স বৃদ্ধির জন্য জন্মসন সংশোধনের আবেদন করেছেন রানু আকতার নামের একজন ভোটার। যার জাতীয় পরিচয়পত্র নং ৫৫১১২২২৮৪৫। বিদ্যমান পরিচয়পত্র অনুযায়ী, রানুর জন্মসন ১৯৭৮ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি। এখন ১৯৮৭ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি করে পরিচয়পত্রে নতুন করে সংশোধন চেয়েছেন। এজন্য উন্মুক্ত বিদ্যালয় থেকে এসএসসি সমমান সনদ জমা দিয়েছেন। কমিশন তার এই বয়স সংশোধনে এত বছরের ব্যবধান দেখে রীতিমতো থমকে দাঁড়িয়েছে। আর ডিপ্লোমা পরীক্ষার সনদ দিয়ে বয়স সংশোধনের আবেদন জানিয়েছেন তানভীর আহমেদ নামের আরেকজন ভোটার। যার আইডি নং ৪৬১৯৬৭১৩৯১। প্রায় সাত বছর বয়স বাড়িয়ে করতে চাইছেন ১৯৯৭ সালের ১০ অক্টোবর। অথচ ভোটার হওয়ার সময় তানভীর জন্ম তারিখ উল্লেখ করেন ১৯৯১ সালের ১০ অক্টোবর।
একইভাবে, হাবিব শিকদার উন্মুক্ত বিদ্যালয়ের সনদ দাখিল করে আট বছর বয়স বাড়ানোর আবেদন করেও তার পরিচয়পত্র সংশোধন করতে পারেননি। কারণ কমিশন প্রকৃত তথ্য যাচাই করে দেখতে পায়, তানভীর যখন ভোটার হন, এখনকার চাওয়া অনুযায়ী, জন্মসনদ সংশোধন করা হলেও তার বয়স দাঁড়ায় ১৩ বছরে, যা ভোটার নিবন্ধন আইন এবং সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কারণ ১৮ বছরের নিচে কাউকে ভোটার করার সুযোগ নেই। হাবিব শিকদারের পরিচয়পত্র নং ৫৯৬৯৪৯৬৭৪৩। তিনি ১৯৮৩ সালের ১ জুন থেকে বয়স বাড়িয়ে ১৯৯১ সালের ২৬ মার্চ করতে চেয়েছিলেন। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ দাখিল করার পর মিথ্যা তথ্যের আশ্রয় নেওয়ার কারণে তার আবেদনটি ইতোমধ্যে কমিশন নাকচ করেছে।
উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ দেখিয়ে নাম সংশোধনের আবেদন করেছেন শিরিন ইসলাম। যার আইডি নং ৪১৭৭২২৪৫২৬। তিনি এখন সনদ অনুযায়ী, নাম পরিবর্তন করে সুরাইয়া ইসলাম শিরিন বানাতে চান।
শুধু তানভীর কিংবা রানু আকতার নন, অসংখ্য ভোটার নাগরিক তথ্য গোপন করে উন্মুক্ত, কারিগরি বোর্ড কিংবা মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড থেকে সনদ নিয়ে পরিচয়পত্র সংশোধনের জন্য আবেদন করেছেন। ইসির একজন উপ-পরিচালক বলেন, ২০০৭-০৮ সালে যাদের ভোটার করা হয় তখন ১.১.১৯৯০ সালের পরে যাদের জন্ম তাদের ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। কারণ এ সনের পরে একজন নাগরিকের বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হয়নি। একইভাবে ২০০৯ সালের হালনাগাদ তালিকায় তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, যাদের জন্ম ১.১.৯২ বা তার পরে। কিন্তু এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব সনদ নিয়ে নাম ও বয়স সংশোধনের আবেদন করছেন, তাদের তথ্যানুযায়ী, পরিচয়পত্রটি সংশোধন করা হলে প্রায় প্রত্যেকের বয়স হবে ১৮ বছরের নিচে। ওই কর্মকর্তা বলেন, এভাবে জেনেশুনে অন্যায় করতে পারি না বলেও আবেদন বাতিল করতে হচ্ছে।
বিশেষ করে, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, কারিগরি শিক্ষা বোর্ড এবং মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের একাধিক সনদ নিয়ে বিপাকে রয়েছে নির্বাচন কমিশন। উদ্ভট ও বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে এসব স্বীকৃত বিদ্যাপীঠে ভর্তি হয়ে হরহামেশায় সনদ পেয়ে যাচ্ছেন দেশের নাগরিকরা। আর এটাকে পুঁজি করে নাগরিকরা তাদের জাতীয় পরিচয়পত্রের নাম ও বয়স সংশোধনের আবেদন জানাচ্ছেন। কিন্তু কমিশন তদন্ত করে বাস্তবতার সঙ্গে মিল খুঁজে না পাওয়ার কারণে স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা সনদ দেখেও অনেক ভোটারের পরিচয়পত্র সংশোধন করতে পারছে না সাংবিধানিক সংস্থাটি।
কমিশন বলছে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ নিয়ে যারাই নাম ও বয়স সংশোধন করতে আসছেন বেশির ভাগের তথ্যে গরমিল রয়েছে। তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, যদি তাদের চাহিদা অনুযায়ী, কাজটি সম্পাদন করে দেওয়া হয় তাহলে জন্মদাতা মা এবং পরিবারের ভাই-বোনদের চেয়ে আবেদনকারীর বয়স কম হয়ে যাচ্ছে।
পাশাপাশি, সর্বোচ্চ একাডেমিক সনদ থাকার পরও বয়স কমানোর জন্য তথ্য গোপন করে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে প্রাথমিক সনদটি নিয়ে নিচ্ছেন। সংশ্লিষ্ট তখন বলেছেন, তিনি বিএ কিংবা এমএ পাস করেননি।
এসব জটিলতা এড়াতে আগামী ৩১ মার্চ কমিশন সভায় এ বিষয়ে আলোচনা করবে কমিশন। এরপর ২ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সভার জন্য নোটিশ জারি করেছে কমিশন।
জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনের যুগ্মসচিব ও জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন অনুবিভাগের পরিচালক (অপারেশন্স) মো. আবদুল বাতেন বলেন, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ আমাদের জন্য গোঁদের ওপর বিষ ফোঁড়ার মতো এখন। নিবন্ধন আইন অনুযায়ী, কোনো নাগরিকের নাম ও বয়স সংশোধন করার ক্ষেত্রে স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয়/ বোর্ডের এসএসসি বা সমমান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ সনদ কার্যকর হবে। কিন্তু অনেক প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি প্রকৃত জন্ম পরিচয় দিয়ে ভোটার হলেও নিজ প্রয়োজনে বয়স কমাতে তথ্য-পরিচয় গোপন করে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন। দুই বছরের শিক্ষাজীবন শেষে এখানের সনদ নিয়ে ভোটার জন্মসন ও নাম সংশোধন করতে ওই সনদটিই ব্যবহার করছেন। আমরা প্রকৃত বয়স এবং সংশোধনের আবেদন করা বয়সের তারতম্য খুঁজতে পরিবারের সদস্য যেমন মা এবং অন্যান্য ভাই-বোনের পরিচয়পত্র সংযুক্ত করতে বলছি। দেখা যাচ্ছে, আবেদনকারী পরিবারের বড় সদস্য হলেও আবেদন করা জন্মসন অনুযায়ী, তার পরিচয়পত্রটি সংশোধন করলে অন্য সদস্য থেকে সে ছোট হয়ে যায়। আবার অনেক ক্ষেত্রে তার মা থেকে বয়সের পার্থক্য হয়ে যাচ্ছে ৩-৪ বছরের। এসব জটিলতা এড়াতে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে বসার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আগামী ৩১ মার্চ কমিশন সভায় এ বিষয়ে আলোচনা করে সমস্যার সমাধানে পৌঁছানো যাবে বলে আমরা মনে করছি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনআইডির এক কর্মকর্তা বলেন, উন্মুক্ত বিদ্যালয়ের অনেক সনদ অনলাইনে যাচাই করেও পাওয়া যাচ্ছে না। অনেকগুলো পাওয়া গেলেও আবেদন অনুযায়ী, সংশোধন করতে পারছি না। এটি করলে অন্যায়কে সমর্থন করা হয়ে যায়। তাই বিষয়ে সুনির্দিষ্ট সমাধান পেতে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পরবর্তী পর্যায়ে কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের সঙ্গে বৈঠকে বসা হবে।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, বয়স সংশোধনের আবেদন করেছে সবুজ অধিকারী নামের একজন ভোটার। যার নং ৭৭৭১৫৩১৮১৬। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ০৯/১২/১৯৯১ জন্মসন থেকে বয়স সাত বছর বাড়িয়ে ১০/১২/১৯৯৮ করার আবেদন করেছেন। দাখিল সদন অনুযায়ী, মুহাম্মদ মিনহাজ উদ্দীন তার বয়স সংশোধনের জন্য ইসিতে আবেদন করেছে। তার ভোটার নং ১৪৮৬৬০৭৩৯১। মিনহাজ আট বছর বয়স বাড়িয়ে ০১/০১/১৯৯১ থেকে ৩১/১২/১৯৯৮ করতে চান। শুধু সুবজ অধিকারী কিংবা মিনহাজ নন, প্রতিদিন দু-পাঁচটি এ ধরনের অযৌক্তিক আবেদন ইসিতে জমা পড়ছে। এ নিয়ে রীতিমতো গলদঘর্ম কমিশন। পরিত্রাণ পেতে সনদ প্রদান করা কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ চেয়েছে নির্বাচন কমিশন। আগামীতে কারো শিক্ষার সুযোগ প্রদানের ক্ষেত্রে কিছুটা শর্তারোপ কিংবা পরিবারের অন্য সদস্যদের কাগজপত্র দেখে ভর্তি করার সে ধরনের পরামর্শ থাকবে ইসির।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস